অর্থনীতিবাংলাদেশ

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য ৫ হাজার ২২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা।

আজ বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন। বাজেট বক্তৃতায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ বরাদ্দের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।

এ ছাড়া ‘সমতার পথে অগ্রযাত্রা’ শিরোনামে জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন ২০২৪-২৫ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট জাতীয় বাজেট ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৭১ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা জেন্ডার–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এটি মোট বাজেটের প্রায় ৩৪ দশমিক ১১ শতাংশ। জেন্ডার–সংশ্লিষ্ট বাজেট বৃদ্ধির হার মোট বাজেট বৃদ্ধির হারের তুলনায় কিছুটা বেশি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম গিরি সৈকতকে বলেন, বাজেটে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। তবে এ বরাদ্দ কীভাবে ব্যয় হবে, তার সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন ও কর্মপরিকল্পনা থাকা জরুরি।

‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’ শিরোনামের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নারী ও শিশুদের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ১১টি অগ্রাধিকারে নারী ও শিশুর বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল। বাজেট বক্তৃতায় যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেই তালিকায়ও নারী ও শিশুর বিষয়টি অনুপস্থিত রয়েছে। ঘুরেফিরে ভাতা, ক্ষুদ্রঋণের মতো বিষয়গুলোই গুরুত্ব পেয়েছে বাজেটে।

কমেছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু, বেড়েছে গড় আয়ু

বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার ২০০৭ সালে ছিল প্রতি লাখে ৩৫১, যা বর্তমানে কমে ১৩৬ জন হয়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর হার ২০০৭ সালে ছিল প্রতি হাজারে ৬০, যা বর্তমানে কমে ৩৩-এ নেমে এসেছে। নবজাতকের মৃত্যুর হার ২০০৭ সালে ছিল প্রতি হাজারে ২৯, যা বর্তমানে ২০ হয়েছে।

প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ২০০৭ সালে ছিল ৬৬ দশমিক ৬ বছর, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২ দশমিক ৩ বছরে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ৫৪ থেকে বর্তমানে ৯৮ দশমিক ২৫ শতাংশ হয়েছে। কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ২০০৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা ২২ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশে।

বাজেট বক্তৃতায় জানানো হয়েছে, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ বিভাগে চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধী হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের টিকা সরকারের টিকা কর্মসূচিতে যুক্ত করা হয়েছে। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরী এবং পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীদের এ কর্মসূচির আওতায় টিকা দেওয়া হচ্ছে।

শ্রমিককল্যাণ ও নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে ৩২টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিনা মূল্যে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৪১৮ জনকে স্বাস্থ্যসেবা, ৫ লাখ ৩৫ হাজার ১৩৩ জনকে পরিবার পরিকল্পনা পরামর্শ ও সেবা দেওয়া হয়েছে। ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৬৭ জনকে চিত্তবিনোদন সেবা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে ৬ হাজার ৪৩০টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ বন্দর ও চট্টগ্রামের কালুরঘাটে মোট ১ হাজার ৫৩০ জন শ্রমজীবী নারীর আবাসনের জন্য বহুতল হোস্টেল, ৫ শয্যার হাসপাতালসহ শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।

নারী ক্ষমতায়নে উদ্যোগ

বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে, অভিবাসন খাতে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯৭ লাখ ৭ হাজার ২৫০ জন বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে নারী কর্মী ১০ লাখ ৮৫ হাজার ১১৭ জন।

নারীর ক্ষমতায়নে দারিদ্র্যপীড়িত ৫০টি উপজেলায় ‘উন্নত জাতের গাভি পালনের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আওতায় ১০০টি সমবায় সমিতির ১০ হাজার উপকারভোগী নারীকে ১২২ কোটি ২০ লাখ টাকা আবর্তক ঋণ দেওয়া হয়েছে।

বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৪ হাজার ২০০ নারী উপকারভোগীর জন্য ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা সমবায় সমিতির মাধ্যমে নারী সমবায়ীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা সৃজন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গ্রামীণ এলাকার মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং শহর এলাকার ‘ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল’ কর্মসূচির অধীন মায়েদের ৩৬ মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ৮০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এই উপকারভোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৪ হাজার ৮০০ থেকে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২৮০–তে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ লাখ ১ হাজার জন প্রবীণের জন্য প্রতি মাসে ৬০০ টাকা হারে মোট ৪ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আগামী অর্থবছরে ভাতাপ্রাপ্ত প্রবীণের সংখ্যা ৬০ লাখ ১ হাজারে উন্নীত করা হবে। এ বাবদ ৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে এতে প্রবীণ নারীর সংখ্যা কত, তা উল্লেখ করা নেই। এ ছাড়া ভাতাপ্রাপ্ত বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত নারীর সংখ্যা ২৫ লাখ ৭৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার করা হবে। এ বাবদ ১ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট-২০২৩ অনুযায়ী বিশ্বে জেন্ডার বৈষম্য সূচকে ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৯তম অবস্থান অর্জন করেছে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়েছে। ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের আওতায় লালসবুজ ডটকম প্ল্যাটফর্মে ১৪ হাজার ৫০০ জন উদ্যোক্তা নিবন্ধন করে পণ্য বিক্রি করছেন।

বক্তৃতায় বলা হয়েছে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ভিজিডি কার্যক্রমের মাধ্যমে ১ কোটি ২২ লাখ নারীকে পুষ্টি চাল ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৭৮ জন গ্রামীণ দুস্থ ও অসহায় নারীকে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়েছে। ১২৫টি শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে ৯ হাজার ৩০ জনকে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে কর্মজীবী মায়েদের সহায়তা করা হচ্ছে। দরিদ্র নারীদের ২৮ হাজার ৮২৫টি সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৯৯ হাজার ৩৬৮টি সমিতিকে ১৪৭ কোটি ৮৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯-এর মাধ্যমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৬৫ লাখ ৪১ হাজার ১৫৩ নারী ও শিশুকে সেবা দেওয়া হয়েছে। ৭ হাজার ৩৩টি ক্লাবের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতাবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিশোরীদের ক্ষমতায়নে বাইসাইকেল দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে ৬৪ জেলায় শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন, কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ ও চার বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়।

বক্তৃতায় বলা হয়েছে, সরকার জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০ প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনের চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে ৯০ হাজার শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ৪৩টি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পোশাক, চিংড়ি, ট্যানারি, কাচ, সিরামিক, জাহাজ রিসাইক্লিং, রপ্তানিমুখী চামড়াজাত শিল্প, পাদুকাশিল্প ও রেশমশিল্প থেকে শিশুশ্রম নিরসন করা হয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button